অপরিকল্পিত বাঁধে বরইতলা নদীর মরণদশা

Admin User ২২ অগাস্ট ২০২৫
অপরিকল্পিত বাঁধে বরইতলা নদীর মরণদশা

পটুয়াখালীর মহিপুর থানাধীন ডালবুগঞ্জ ও মহিপুর সদর ইউনিয়নের মধ্যদিয়ে বয়ে গেছে বরইতলা নদী। কাগজে-কলমে নদীটির নাম বরইতলা হলেও কেউ একে ‘সোনামুখী’, আবার কেউ ‘গাববাড়িয়া নদী’ নামেও চেনে। এক সময়ের খরস্রোতা এ নদীর গাববাড়িয়া পয়েন্টে অপরিকল্পিত বাঁধ নির্মাণের কারণে এখন মৃতপ্রায় অবস্থা।

সরেজমিনে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ওই বাঁধের কারণে নদীতে পানির স্বাভাবিক প্রবাহ বন্ধ হয়ে তিন দিকের শাখা নদী মৃতপ্রায় হয়ে পড়েছে। বেড়িবাঁধের ভেতরের পানি নিষ্কাশনের জন্য থাকা ১৯টি স্লুইসগেট অকেজো হয়ে গেছে। এখন জোয়ারের সময় পানি ওঠে কিন্তু ভাটায় নামে না। এতে ভেতরের খালগুলো স্থায়ীভাবে জলাবদ্ধ হয়ে পড়েছে।

ফলে ডালবুগঞ্জ, ধুলাসার, মিঠাগঞ্জ, মহিপুর ও বালিয়াতলী ইউনিয়নের অন্তত ৪০টি গ্রাম বর্ষা মৌসুমে তলিয়ে যায়। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে অন্তত ৭৫ হাজার একর কৃষিজমি, চরম দুর্ভোগে পড়েছেন অর্ধলাখের বেশি কৃষক। তারা জানান, আগে খালবিলের পানি সেউচি (অযান্ত্রিক পদ্ধতি) ব্যবহার করে সহজেই জমিতে সেচ দেয়া যেত। কিন্তু এখন যান্ত্রিক সেচের ওপর নির্ভর করতে হচ্ছে, যা অত্যন্ত ব্যয়বহুল।

এতে কৃষি উৎপাদনের খরচ বেড়ে গেছে। একই সঙ্গে বেড়েছে উৎপাদিত ফসলের দাম। বর্ষার শুরুতেই হাঁটু থেকে কোমর সমান পানিতে তলিয়ে যায় আমন জমি। স্থায়ী জলাবদ্ধতায় কৃষকরা বীজতলা পর্যন্ত করতে পারেন না। গবাদিপশু পালনেও পড়েছেন বিপাকে।

তবে অপরিকল্পিত বাঁধ নির্মাণের ফলে বরইতলা-সোনাতলা সংযোগ নদীর চারটি শাখা নদীর পানি প্রবাহ বন্ধ হয়ে গেছে। ভাটার সময় সাপুড়িয়া হয়ে পানি নামতে নামতে আবার জোয়ার এসে যায়। এছাড়া প্রায় সব স্লুইসগেটেই পলি জমে কার্যত মাটির নিচে দেবে গেছে। পানির প্রবাহ বন্ধ হয়ে কাঁটাভাড়ানি খাল ও বরইতলা নদী দ্রুত ভরাট হয়ে যাচ্ছে। ছইলা-কেওড়া বাগানসহ সংরক্ষিত ম্যানগ্রোভ বনভূমিও ঝুঁকির মুখে।

একসময় এই নদীপথ দিয়ে নৌকা, লঞ্চ, ট্রলার চলাচল করত। ভাসানি ব্যবসায়ীরা নৌকায় মালামাল নিয়ে হাটে যেতেন। এখন নৌ-যোগাযোগ বন্ধ হয়ে গেছে। শাখা খালগুলোতে পলি জমে নদী ভূমিতে পরিণত হচ্ছে। এর ফলে ব্যবসা-বাণিজ্য, পরিবহন ও মৎস্যজীবী সম্প্রদায়ের জীবিকা সম্পূর্ণরূপে ভেঙে পড়েছে। এক কথায় বিস্তীর্ণ জনপদের জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। 

মনসাতলী গ্রামের কৃষক মো. সিদ্দিক বলেন, ‘বরইতলা নদীতে বাঁধ দেয়ার কারণে পানির প্রবাহ কমে গেছে। এছাড়া বাবলাতলা স্লুইস খালে ওক্কাচোরা পয়েন্টে বাঁধ দিয়ে ছোট পুকুর বানানো হয়েছে। আবার স্থানীয় প্রভাবশালীরা নদীর মুখে জাল পেতে কৃত্রিম জলাবদ্ধতা তৈরি করেছে। এখন বীজ ধান ফেলতেও ভোগান্তি।’

মিরপুর গ্রামের কৃষক মো. আলতাফ বলেন, ‘বরইতলা নদী আর নদী নেই, মরে গেছে। এক সময় এ নদী খরস্রোতা ছিল। মাছও ছিল। জেলেরা মাছ শিকার করে জীবিকা নির্বাহ করতেন। এখন নদী শুধু নামে। একেবারে ভরাট হয়ে গেছে। এখন এপার থেকে ওপারে হেঁটে যাওয়া যায়।’

বাঁধ নির্মাণের সময় ডালবুগঞ্জ ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান মরহুম আব্দুস সালাম সিকদারসহ হাজার হাজার কৃষক মানববন্ধন ও প্রতিবাদ সমাবেশ করেছিলেন।

স্থানীয়রা জানান, ওই স্থানে একটি গার্ডার ব্রিজ নির্মাণের উদ্বোধন হলেও রহস্যজনকভাবে কাজ বন্ধ হয়ে যায়। অথচ ব্রিজ নির্মাণে খরচ কম হতো এবং পানি প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হতো না। কিন্তু পানি উন্নয়ন বোর্ড পরিকল্পনাহীনভাবে বাঁধ তৈরি করে নদীকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিয়েছে। 

পরিবেশবাদী সংগঠন ধরিত্রী রক্ষায় আমরা-ধরা’র সমন্বয়ক ও নদী রক্ষা আন্দোলনের কর্মী মেজবাহউদ্দিন মাননু বলেন, ‘বাঁধ দিয়ে নদীর বুক ভরাট করা নদী হত্যার শামিল। এতে পানির প্রবাহ কমে নদী ও আশপাশের খাল ভরাট হয়ে যাচ্ছে।’ 

কৃষিবিদরা জানান, ভূগর্ভস্থ পানির ব্যবহার বাড়ায় জমির উর্বরতা কমেছে। ফলে ভালো ফসল ফলাতে কৃষকদের সার ও কীটনাশকে বেশি খরচ করতে হচ্ছে। দেশি মাছ হারিয়ে যাচ্ছে, জীববৈচিত্র্য হুমকির মুখে পড়েছে। 

এ বিষয়ে কলাপাড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ভারপ্রাপ্ত) মো. ইয়াসীন সাদেক বলেন, ‘খোঁজখবর নিয়ে কৃষক ও সাধারণ মানুষের ভোগান্তি লাঘবে টেকসই সমাধানের উদ্যোগ নেয়া হবে।’